এক্সিম ব্যাংকের মতো ঘটনা ফের ঘটলে এমডি মিলবে না
প্রথম আলো | ০৬ জুন ২০২০
ব্যাংক খাতের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকারস বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান আলী রেজা ইফতেখার। তিনি বেসরকারি ইস্টার্ণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। বাজেট, প্রণোদনাসহ ব্যাংক খাতের সার্বিক দিক নিয়ে তিনি গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফখরুল ইসলাম

প্রথম আলোমানুষের জীবনযাত্রা স্থবির। কলকারখানা বন্ধ। করোনাভাইরাসের সংক্রমণে অর্থনীতি প্রায় বিপর্যস্ত। পুনরুদ্ধারে সরকার এক লাখ কোটি টাকার বড় আকারের প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। ব্যাংক খাত কীভাবে তা বাস্তবায়ন করছে?

আলী রেজা ইফতেখারপ্রণোদনা প্যাকেজের ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ বাস্তবায়নের দায়িত্ব ব্যাংক খাতের। এর মধ্যে ৫ হাজার কোটি টাকার প্রথম প্যাকেজ রপ্তানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের মজুরি দিতে। বেশ ভালোভাবেই এর বাস্তবায়ন হচ্ছে। মে মাসের মজুরি আগামী ১০ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে বিতরণ হবে। বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকার যে প্যাকেজ, তার আওতায় অনেক আবেদন অনুমোদিত হয়েছে। এগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকে আছে। আগামী সপ্তাহ থেকে চূড়ান্ত হবে। তবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের (এসএমই) জন্য যে ২০ হাজার কোটি টাকা, এখানে কিছু শর্ত আছে। খাতভিত্তিক ঘাটতি আছে।

প্রথম আলো: ৫০ হাজার কোটি টাকা তো আর বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর তহবিল থেকে যাচ্ছে না, তাই না?

আলী রেজাতা যাচ্ছে না। অর্ধেক পাওয়া যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পুনঃ অর্থায়ন কর্মসূচি থেকে ৪ শতাংশ সুদে। বাকি অর্ধেক ব্যাংক খাতের নিজস্ব। ফলে ২৫ হাজার কোটি টাকার তারল্য এখানে জড়িত। এ ক্ষেত্রে ঝুঁকিও আছে। অন্যদিকে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে গ্রাহককে দেবে বাণিজ্যিক ব্যাংক। গ্রাহক থেকে এ টাকা আদায়ের দায়িত্ব বাণিজ্যিক ব্যাংকের। কিন্তু গ্রাহক টাকা ফেরত না দিলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে টাকা কেটে রাখবে। তাই আমরা বলে আসছি, সরকার একটা ঋণঝুঁকি নিশ্চয়তা কর্মসূচি হাতে নিক। এতে ব্যাংক খাতের ঝুঁকি কমবে।

প্রথম আলো: ঋণঝুঁকি নিশ্চয়তা কর্মসূচির কথা জেনে গ্রাহকেরা তখন ঋণ ফেরত না দিতে আরও মওকা পেয়ে যাবে না?

আলী রেজা: সে সুযোগ নেই। কারণ, ঋণের টাকা আদায়ে ব্যাংক মামলা থেকে শুরু করে যা যা করার সবই করবে এবং এগুলোর তথ্য-উপাত্ত বাংলাদেশ ব্যাংককেও জানাবে। বড় কথা হচ্ছে কর্মসূচিটি না হলে ব্যাংক খাতের আয় কমতে পারে। এমনিতেই ঋণ-আমানতের সুদ ৯-৬ শতাংশ কার্যকরের কারণে আয় কমার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

প্রথম আলোসুদের হার ৯-৬ করার ফলে ব্যাংক খাতের আয় কমবে ১৬ হাজার কোটি টাকা। এ আয় থেকে অন্তত ৬ হাজার কোটি টাকা সরকার রাজস্ব পেত। এখন এ টাকাটা কম পাবে। রাজস্ব কম পাওয়ার আশঙ্কা থাকলেও সার্বিক স্বার্থে ৯-৬ শতাংশ কার্যকর করেছে সরকার, আপনার কী মত?

আলী রেজা: দ্বিমত নই। ৬ শতাংশের প্রজ্ঞাপন কিন্তু হয়নি। শুধু সরকারি প্রতিষ্ঠানের টাকা আমানত রাখার কথা বলা হয়েছে। এসব আমানত বেসরকারি ব্যাংক কমই পায়। মুশকিল হচ্ছে স্থায়ী আমানত (এফডিআর), মিলিয়নিয়ার স্কিম, ৬ বছর বা ৭ বছরে দ্বিগুণ—এসব স্কিমের সুদ ১২ থেকে সোয়া ১২ শতাংশ। গ্রাহকদের সঙ্গে যেহেতু চুক্তি আছে, ফলে সুদগুলো কিন্তু ব্যাংককে বহন করতে হবে। কোনো কোনো স্কিমের মেয়াদ শেষ হবে ২০২৩-২৪ সালে।

প্রথম আলোদুই মাসের সুদ স্থগিতের একটা হিসাবও তো আছে।

আলী রেজা: হ্যাঁ, এর জন্যও ব্যাংক খাতের ক্ষতি হবে ১৬ হাজার কোটি টাকা। এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দিয়েছেন যে ২ হাজার কোটি টাকা সুদ ভর্তুকি দেবেন, যা ১ দশমিক ২ শতাংশ।  আর ভর্তুকির এই টাকা কীভাবে হিসাব হবে, ১২ মাসের হিসাব কোন মাস থেকে গণনা হবে, ব্যালান্স শিটে কীভাবে দেখানো হবে—এসব মিলিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটা প্রজ্ঞাপন জারি করবে। আমরা অপেক্ষা করছি।

প্রথম আলো: তার মানে আগামী সময়ে ব্যাংক খাতের গড় মুনাফা কমে যাচ্ছে?

আলী রেজা: অবশ্যই। ব্যাংক খাতের স্বাস্থ্য কখনোই কমতে দেওয়া যাবে না। এতে বিদেশি ব্যাংক ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছে আমাদের ব্যাংক খাতের মান (রেটিং) কমবে। কমে যাবে ঋণপত্রের সীমা। বিদেশিরা স্বল্প সুদে ঋণ দিতে কার্পণ্য করবে।

প্রথম আলো: তাহলে করণীয় কী? সামনে তো বাজেট আসছে, আপনার কোনো পরামর্শ আছে?

আলী রেজা: ঋণঝুঁকি নিশ্চয়তাকর্মসূচিটি দরকার। বাজেটে করপোরেট কর কিছুটা কমানো হোক। এতে ব্যাংক খাত স্বস্তি পাবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো যে নগদ জমা (সিআরআর) রাখে, তা থেকে সুদ পাওয়া যায় না। কম হলেও সিআরআরের ওপর একটা সুদ পেতে পারে ব্যাংকগুলো।

প্রথম আলো: ব্যাংক খাতের তারল্য পরিস্থিতি ঠিক আছে তো?

আলী রেজা: এখন পর্যন্ত ঠিক আছে। কারণ, ঋণ নেওয়ার চাপ নেই। তবে সরকার ব্যাংক খাত থেকে বেশি বেশি ঋণ নিচ্ছে। এ জন্য নিকট ভবিষ্যতে বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি কমতে পারে। জ্বালানি তেলের দাম কম থাকায়, আমদানি ব্যয় কম হওয়ায় এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল থেকে বাজেট সহায়তা পাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন রেকর্ড উচ্চতায়। তবে রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বেশি কমলে গভীর ভাবনায় পড়তে হবে।

প্রথম আলোব্যাংক খাতেনতুন এক উদাহরণ তৈরি হলো গত মাসে। এক্সিম ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও একজন অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালককে (এএমডি) ন্যাশনাল ব্যাংকের দুই পরিচালক গুলি করে খোঁড়া করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন। এ অভিযোগে থানায় মামলা হয়েছে। দুই পরিচালক আবার নিজস্ব উড়োজাহাজে করে দেশও ছেড়েছেন। কেমনভাবে দেখছেন এ ঘটনা?

আলী রেজাএটা সত্যিই অনভিপ্রেত ঘটনা। ব্যাংকারদের ওপর এ ঘটনায় একজন ব্যাংকার হিসেবে আমি খুবই মর্মাহত। ব্যাংক খাতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলে ভবিষ্যতে কোনো ব্যাংক ভালো এমডি (ব্যবস্থাপনা পরিচালক) পাবে না। সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে এর দ্রুত পদক্ষেপ চাই। এবিবির পক্ষ থেকে আমরা এর নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছি। নতুন করে আর কিছু বলতে চাই না।

প্রথম আলো: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

আলী রেজাআপনাকেও ধন্যবাদ।

 

Link:https://www.prothomalo.com/economy/article/1660922/%E0%A6%8F%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%B8%E0%A6%BF%E0%A6%AE-%E0%A6%AC%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A6%82%E0%A6%95%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%AE%E0%A6%A4%E0%A7%8B-%E0%A6%98%E0%A6%9F%E0%A6%A8%E0%A6%BE-%E0%A6%AB%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%98%E0%A6%9F%E0%A6%B2%E0%A7%87-%E0%A6%8F%E0%A6%AE%E0%A6%A1%E0%A6%BF-%E0%A6%AE%E0%A6%BF%E0%A6%B2%E0%A6%AC%E0%A7%87-%E0%A6%A8%E0%A6%BE