দেশসেরা ব্যাংক ইস্টার্ন তারপর সিটি ও ডাচ্-বাংলা

হাছান আদনান ও মেহেদী হাসান রাহাত


দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ৩০টি ব্যাংক নিয়ে ২০১৩ সালে প্রথম সেরা ব্যাংক নির্বাচন করে বণিক বার্তা। তার পর থেকেই প্রতি বছর এ র‍্যাংকিং প্রকাশ করা হচ্ছে। ২০২১ সালের আর্থিক প্রতিবেদনের ভিত্তিতে এবার দশম র‍্যাংকিং তৈরি করা হয়েছে। এক্ষেত্রে বৈশ্বিক মানদণ্ড অনুসরণ করে সাতটি নির্দেশকে স্কোরিংয়ের মাধ্যমে ব্যাংকগুলোর আর্থিক কার্যক্রমের মূল্যায়ন করা হয়েছে

২০২১ সাল ছিল নভেল করোনাভাইরাস সৃষ্ট দুর্যোগ সামাল দেয়ার বছর। সংক্রমণের প্রকোপ বাড়লেও মানুষের মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছিল সাহস। সংকটকে পাশ কাটিয়ে প্রাণবন্ত ছিল দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। সে সময় ব্যাংকগুলোকে নীতিসহায়তা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। সমস্যা ও সম্ভাবনার দোলাচলের বছরে প্রত্যাশার চেয়েও ভালো করেছে দেশের বেশকিছু ব্যাংক। আবার ভালো অবস্থানে থাকা কিছু ব্যাংক নিজেদের মর্যাদা খুইয়েছে।

গত বছরের আর্থিক প্রতিবেদনের ভিত্তিতে দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর র‍্যাংকিং করেছে বণিক বার্তা। ২০১৩ সাল থেকে প্রতি বছরই নিয়মিতভাবে এ র‍্যাংকিং প্রকাশ করা হচ্ছে। বিভিন্ন করপোরেট রিসার্চ টিমের সহায়তায় দশমবারের মতো এটি প্রস্তুত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে লংকাবাংলা অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, এবারের র‍্যাংকিংয়ে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ৩০টি ব্যাংকের মধ্যে ২০টির প্রাপ্ত স্কোর বেড়েছে। কমেছে ১০টি ব্যাংকের। গত বছরের র‍্যাংকিংয়ে শীর্ষস্থানে থাকা ডাচ্-বাংলা ব্যাংক লিমিটেড এবার তৃতীয় স্থানে নেমে এসেছে। শীর্ষে উঠে এসেছে ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড (ইবিএল)। গত বছর তৃতীয় স্থানে থাকা দ্য সিটি ব্যাংক লিমিটেড এবার আরো এক ধাপ এগিয়ে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে। তবে শীর্ষ তিন ব্যাংকেরই প্রাপ্ত নম্বর ৩৫-এর ঘরে। ফলে ব্যাংকগুলোর মধ্যে শীর্ষস্থান দখল নিয়ে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়েছে।

গোটা বিশ্বেই একটি ব্যাংকের সক্ষমতা, পারফরম্যান্স ও প্রকৃত পরিস্থিতির চিত্র বিশ্লেষণে নির্দিষ্ট কিছু মানদণ্ড বা নির্দেশক ব্যবহার করা হয়। এগুলো হচ্ছে সম্পদের বিপরীতে আয় (রিটার্ন অন অ্যাসেট বা আরওএ), শেয়ারহোল্ডারদের মালিকানার বিপরীতে আয় (রিটার্ন অন ইকুইটি বা আরওই), শ্রেণীকৃত ঋণ (এনপিএল) অনুপাত, কর-পরবর্তী নিট মুনাফা, শেয়ারপ্রতি নিট সম্পদমূল্য (এনএভিপিএস), মূলধন পর্যাপ্ততার অনুপাত (ক্যাপিটাল অ্যাডিকুয়েসি রেশিও বা সিএআর) ও শাখাপ্রতি পরিচালন মুনাফা (ওপিবি)। আগের বছরগুলোয় শেয়ারপ্রতি আয়কে (ইপিএস) সেরা ব্যাংক নির্ধারণের ক্ষেত্রে অন্যতম নির্দেশক হিসেবে বিবেচনা করা হতো। তবে ২০২০ সাল থেকেই সেরা ব্যাংক নির্ধারণের ক্ষেত্রে নির্দেশক হিসেবে ইপিএসের পরিবর্তে কর-পরবর্তী নিট মুনাফাকে বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে। মূলত স্টক লভ্যাংশ ঘোষণা করার কারণে ব্যাংকের নিট মুনাফায় হেরফের না হলেও ইপিএস কমে যায়। এ কারণেই ইপিএসের পরিবর্তে নিট মুনাফাকে বিবেচনা করা হয়েছে।

র‍্যাংকিংয়ে আরওএর ক্ষেত্রে শীর্ষ মান নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ শতাংশ। একইভাবে আরওইর ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ, এনপিএলের ক্ষেত্রে ১ শতাংশ, সিএআরের ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ, নিট মুনাফার ক্ষেত্রে ১ হাজার কোটি টাকা, এনএভিপিএসের ক্ষেত্রে ১০০ টাকা এবং ওপিবির ক্ষেত্রে ১০ কোটি টাকাকে শীর্ষমান হিসেবে ধরা হয়েছে। আর প্রতিটি নির্দেশকের সর্বোচ্চ নম্বর ধরা হয়েছে ১০।

লংকাবাংলা অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির সহকারী ব্যবস্থাপক মো. মোস্তফা নোমান এ র‍্যাংকিং তৈরির কাজে যুক্ত ছিলেন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ঋণ শ্রেণীকরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি ছাড়, কভিড-পরবর্তী সময়ে ব্যবসা-বাণিজ্যে ঊর্ধ্বগতি ও আমানতের নিম্ন সুদহারের কারণে ২০২১ সালে অধিকাংশ ব্যাংক ভালো মুনাফা করেছে। অবশ্য ঋণ শ্রেণীকরণে নীতি ছাড় সত্ত্বেও বেশির ভাগ ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে। ২০২১ সাল শেষে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের হার দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৯ শতাংশে, যা আগের বছর ছিল ৭ দশমিক ৬ শতাংশ। নীতি ছাড় উঠিয়ে নেয়ার পর পরিস্থিতির আরো অবনতি এড়াতে ব্যাংকগুলোকে আরো দক্ষতার সঙ্গে তাদের ঋণ ব্যবস্থাপনা করতে হবে। অধিকন্তু উচ্চমূল্যস্ফীতি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের রক্ষণশীল মুদ্রানীতির কারণে স্প্রেডের (আমানত ও ঋণের সুদহারের পার্থক্য) ওপর চাপ তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

সাত নির্দেশকের ভিত্তিতে তৈরি এ র‍্যাংকিংয়ে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে রয়েছে যথাক্রমে ইবিএল, দ্য সিটি ব্যাংক ও ডাচ্-বাংলা ব্যাংক লিমিটেড। এর আগে ২০২০ সালের পারফরম্যান্স নিয়ে গত বছর করা র‍্যাংকিংয়েও ব্যাংকগুলো শীর্ষ তিনে ছিল। এবারের র‍্যাংকিংয়ে শীর্ষ দশে জায়গা করে নেয়া অন্য ব্যাংকগুলো হলো ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেড, প্রিমিয়ার ব্যাংক লিমিটেড, ব্র্যাক ব্যাংক লিমিটেড, প্রাইম ব্যাংক লিমিটেড, ব্যাংক এশিয়া, মার্কেন্টাইল ব্যাংক লিমিটেড ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক (এমটিবি) লিমিটেড।

নিট মুনাফা ও এনএভিপিএস বাদে পাঁচটি নির্দেশকের ভিত্তিতে করা এবারের র‍্যাংকিংয়ে শীর্ষ তিনের মধ্যে রয়েছে ইবিএল, সিটি ব্যাংক ও ট্রাস্ট ব্যাংক। গত বছর প্রকাশিত র‍্যাংকিংয়ে এ তালিকায় শীর্ষে ছিল ইবিএল, ডাচ্-বাংলা ও সিটি ব্যাংক।

দুই বছরের র‍্যাংকিং উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গতবারের তুলনায় এবারের র‍্যাংকিংয়ে সার্বিক স্কোর বেড়েছে ২০টি ব্যাংকের। এগুলো হলো ইবিএল, সিটি ব্যাংক, ট্রাস্ট ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, এমটিবি, এনসিসি ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, উত্তরা ব্যাংক, আইএফআইসি, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক (এসআইবিএল), এবি ব্যাংক ও আইসিবি ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড।

অন্যদিকে স্কোর হ্রাস পাওয়া ১০ ব্যাংকের তালিকায় রয়েছে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক, যমুনা ব্যাংক, সাউথইস্ট ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি), আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক (এনবিএল) ও রূপালী ব্যাংক লিমিটেড।

২০২০ সালের র‍্যাংকিংয়ে সাতটি সূচকের মধ্যে ছয়টিতেই প্রথম স্থান অর্জন করে শীর্ষস্থান দখলে নিয়েছিল ডাচ্-বাংলা ব্যাংক লিমিটেড। কিন্তু এক বছরের ব্যবধানে নিজের অবস্থান খুইয়েছে ব্যাংকটি। ২০২১ সালের র‍্যাংকিংয়ে দেশসেরা ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড। ৭০-এর স্কেলে ব্যাংকটির স্কোর ৩৫ দশমিক ৬৫। দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে দ্য সিটি ব্যাংক। আর ডাচ্-বাংলা ব্যাংক নেমে গিয়েছে তৃতীয় স্থানে। এর মধ্যে সিটি ব্যাংকের স্কোর ৩৫ দশমিক ৬১ আর ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ৩৫ দশমিক ১৫।

More Details